প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচনে রাজি বিএনপি, তবে…

নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচন নয়-এতদিন এমন দাবিতে অনড় থাকলে আন্দোলন মাঠে মারা যাওয়ার পর থেকে বিএনপিকে এ ইস্যুতে অনেকটাই নমনীয় মনে হচ্ছে এখন।
খালেদা জিয়ার উপদেষ্টারা এর আগে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে ছাড় দেয়ার কথা বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে বললেও সর্বশেষ বিএনপি চেয়ারপারসনের কথায়ও সে বিষয়টি বেশ জোরেসোরেই উঠে এসেছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের বক্তব্যের পর বিএনপির নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, শর্তসাপেক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেও নির্বাচনে রাজি বিএনপি।
তবে সেজন্য দলটির নেতারা সরকারের কাছ থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের গ্যারান্টি, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনসহ বেশ কিছু দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে পূর্ণ আশ্বাস চান।
বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা এখন যেকোনো মূল্যে একটি মধ্যবর্তী জাতীয় নির্বাচন চান। সেজন্য কিছু বিষয় ছাড় দিতেও তাদের আপত্তি নেই। তবে সেক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদেরও ছাড় দিতে হবে।
গত শনিবার রাতে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময়ে দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আগামী নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে তার দলের অবস্থান তুলে ধরেন। এসময় তিনি দীর্ঘদিনের দাবি ‘তত্ত্বাবধায় সরকার’ নাম বাদ দিলেও নির্বাচনে আপত্তি নেই এমনটা জানান। তবে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন দাবি করেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।
আওয়ামী লীগের দাবি অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করতে বাধ্য হয় বিএনপি। পরে এই ব্যবস্থায় নির্বাচনে ক্ষমতায়ও আসে আওয়ামী লীগ। পরবর্তী সময়ে ২০১১ সালের জুন মাসে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা বাতিল করে রায় দেন সুপ্রিমকোর্ট।
এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবিতে মাঠে নামে বিএনপি। একই দাবিতে ২০১৪ সালের শেষ দিকে দশম সংসদ নির্বাচনের আগে চলে তুমুল আন্দোলন। কিন্তু নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হয় বিএনপি। আওয়ামী লীগ সংবিধানের আলোকে নিজেদের অধীনে নির্বাচন দেয়।
পরে আবারও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন চেয়ে চলতি বছরের শুরুতে তিন মাস টানা হরতাল অবরোধ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো ফলাফল ছাড়াই কর্মসূচি বন্ধ হয়ে যায়।
এমন পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় খুঁজতে থাকে বিএনপি। এজন্য পরামর্শ করতে দলের নেতাদের বাইরেও বিএনপিমনা পেশাজীবীদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন বিএনপি প্রধান।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, সংবিধানের আলোকে নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের কড়া অবস্থানের কারণে পরিকল্পনা হয় তত্ত্বাবধায়কের দাবি থেকে কিছুটা সরে আসার। পেশাজীবীদের দেয়া পরামর্শ অনুযায়ী সরকারকে নির্বাচনের পথে আনতে এ বিষয়ে যথাসম্ভব ছাড় দেয়ারও সিদ্ধান্ত হয়। এরই আলোকে শনিবার রাতে তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে কথা বলেন খালেদা জিয়া।
এছাড়াও সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক না হলেও প্রধানমন্ত্রীকে রেখে কিভাবে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য একটি ফর্মুলা তৈরি করা যায় তা নিয়ে কাজ শুরু হয়। এতে শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক ড. এমাজউদ্দিন আহমদ নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে জানা যায়। এই ধরনের একটি ফর্মুলা তৈরির কাজ চলছে বলে একটি দৈনিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমাজউদ্দিন স্বীকারও করেছেন।
তবে এ বিষয়ে বিএনপি নেতারা তেমন কিছু জানেন না বলে ঢাকাটাইমসকে জানিয়েছেন।
তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে খালেদা জিয়া এর আগে একাধিকবার একইরকম বক্তব্য দিলেও এবারের বক্তব্যের পর রাজনৈতিক মহলে নানা আলোচনা চলছে। প্রশ্ন উঠেছে- তাহলে কি বিএনপি তত্ত্বাবধায়কের দাবি থেকে পুরোপুরি সরে গেল। অনেকে এও বলছেন, বিএনপি তাহলে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখেই নির্বাচনে যেতে প্রস্তুত।
তবে কারও কারও মত হলো-দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনের মাশুল দিচ্ছে বিএনপি। সে কারণে এখন নিজেদের অস্তিত্ব টেকাতে দলটি তত্ত্বাবধায়ক থেকে সরে আসছে।
খালেদা জিয়ার বক্তব্যের বিষয়ে কথা বললে বিএনপির থিঙ্কট্যাঙ্কখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. এমাজউদ্দীন আহমদ ঢাকাটাইমসকে বলেন,  অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বর্তমান সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপতি স্বপদে থাকলেও নির্বাচনে বিএনপির আপত্তি নেই। তবে এজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সরকারকেই নিতে হবে।
তবে এমন পরিবেশ তৈরির জন্য সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই ব্যাপারে চূড়ান্ত সমঝোতার প্রতি জোর দেন এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।
আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক বাতিল হওয়ায় এ নিয়ে কথা বললে আদালত অবমাননার অভিযোগও তোলা হতে পারে এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করেন তিনি। সেক্ষেত্রে সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় খালেদা জিয়ার বর্তমান অবস্থান ঠিক আছে বলে মত দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েল সাবেক এই উপাচার্য।
আর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার ঢাকাটাইমসকে বলেন, “আমরা চাই সুষ্ঠু নির্বাচন। সেজন্য প্রধানমন্ত্রীকে রেখে নির্বাচন করলেও সমস্যা নেই। তবে নির্বাচনকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে দূরে থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনবেন না এমন গ্রহণযোগ্য কাউকে এই দুটো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে এবং এই দুটো মন্ত্রণালয়ে তাদের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব বজায় রাখতে হবে। তাহলে প্রধানমন্ত্রী থাকলেও নির্বাচনে আপত্তি নেই, এটা আমার ব্যক্তিগত মত।”
একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে কিছু ছাড় দিতে হবে বলেও মনে করেন এই আইনজ্ঞ।
প্রধান দুই দলের মধ্যে সংলাপের প্রতি জোর দিয়ে তিনি বলেন, “সংলাপে বসলে আশা করি অবশ্যই সমাধান বের হবে। কিন্তু আগেই যদি বলা হয় সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচন হবে না তাহলে তো সংলাপের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।”
বিএনপি কি নতুন কোনো ফর্মুলা তৈরি করছে- এমন প্রশ্নে জমিরউদ্দিন বলেন, “না এ বিষয়ে দলের মধ্যে আলোচনা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তবে শিগগিরই বৈঠকে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে।”
আর স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, “আমরা তো সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী দাড়ি, সেমিকোলনসহ পুনর্বহাল চাচ্ছি না। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। আমরা মনে করি সে লক্ষে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে সংলাপের ব্যবস্থা করা হোক। সংলাপ হলে সমাধান বের হয়ে আসবে।”
বিএনপি মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য কোনো ফর্মুলা তৈরি করছে কিনা-জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে আমার জানা নেই।”
Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর